মুসলিম উত্তরাধিকার আইন (Islamic Inheritance Law) এবং বাংলাদেশ পারিবারিক আইন (Bangladesh Family Laws) এর মাঝে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য আছে। সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করছি:
১. উৎস (Source of Authority)
- মুসলিম উত্তরাধিকার আইন
- মূল উৎস: কুরআন (যেমন সুরা নিসা ৪:১১-১২, ৪:১৭৬), সহিহ হাদিস, সাহাবা ও তাবেঈনের ইজমা, এবং কিয়াস।
- এটি শরীয়াহ ভিত্তিক, চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়।
- মুসলমানদের জন্য এটি ধর্মীয় কর্তব্য (ফরয)।
- বাংলাদেশ আইন
- উৎস: বাংলাদেশের সংবিধান, Family Court Ordinance 1985, Succession Act 1925, এবং অন্যান্য সংসদীয় আইন।
- এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর হয়।
- মুসলমানদের জন্য inheritance-এর ক্ষেত্রে শরীয়াহকে সাধারণত অনুসরণ করা হয়, তবে কাগজপত্র, রেজিস্ট্রেশন ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে হয়।
২. উত্তরাধিকার বণ্টন (Distribution of Shares)
- মুসলিম আইন
- কুরআনে নির্ধারিত হার অনুযায়ী বণ্টন হয় (যেমন: স্ত্রী ১/৮ বা ১/৪, কন্যা ১/২ বা ২/৩, ছেলে = মেয়ের দ্বিগুণ)।
- কোনো মানুষ নিজের ইচ্ছায় পরিবর্তন করতে পারে না।
- উত্তরাধিকারীদের শেয়ার নির্দিষ্ট ও স্থায়ী।
- বাংলাদেশ আইন
- মুসলমানদের ক্ষেত্রে শরীয়াহ অনুযায়ী বণ্টনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
- তবে রাষ্ট্রীয় প্রয়োগে ওয়ারিশ সনদ, মিউটেশন (Mutation), নামজারি, এবং প্রয়োজনে আদালতের ডিক্রি লাগে।
- অমুসলিমদের ক্ষেত্রে আলাদা আইন (যেমন: হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, খ্রিস্টান Succession Act)।
৩. উইল (Will / وصية)
- মুসলিম আইন
- মৃত্যুর আগে সর্বোচ্চ ১/৩ সম্পত্তি উইল করা বৈধ।
- কোনো উত্তরাধিকারীর পক্ষে উইল করা বৈধ নয় (যেমন ছেলেকে বা মেয়েকে আলাদা করে উইল দেওয়া যাবে না)।
- এটি শরীয়াহ ভিত্তিক সীমাবদ্ধ।
- বাংলাদেশ আইন
- Succession Act 1925 অনুযায়ী উইল লিখিত ও রেজিস্ট্রি করা যায়।
- মুসলমানদের ক্ষেত্রে আদালত শরীয়াহর সীমা (১/৩ পর্যন্ত) সাধারণত মেনে চলে।
- বাস্তবে অনেক সময় আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক জটিলতা দেখা যায়।
৪. প্রক্রিয়া (Procedure of Inheritance)
- মুসলিম আইন
- পরিবার/আত্মীয়দের মধ্যে শরীয়াহ অনুযায়ী বণ্টন করা যায়।
- কাগজপত্র জরুরি নয়, শুধু ইসলামী শরীয়াহর নিয়ম মানলেই যথেষ্ট।
- বাংলাদেশ আইন
- সরকারীভাবে সম্পত্তি ভোগ/ভাগ করতে হলে:
- ইউনিয়ন পরিষদ/সিটি কর্পোরেশন থেকে ওয়ারিশ সনদ নিতে হয়।
- জমির খতিয়ান ও নামজারি করতে হয়।
- প্রয়োজনে Family Court বা Civil Court এর মাধ্যমে ডিক্রি নিতে হয়।
- অর্থাৎ আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া উত্তরাধিকার বাস্তবে কার্যকর হয় না।
- সরকারীভাবে সম্পত্তি ভোগ/ভাগ করতে হলে:
৫. পরিবর্তনযোগ্যতা (Flexibility)
- মুসলিম আইন
- আল্লাহর বিধান; কোনো সংসদ বা রাষ্ট্র এটি পরিবর্তন করতে পারবে না।
- ইজতিহাদ শুধু নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগের জন্য হয়, কিন্তু কুরআনে নির্ধারিত অংশে পরিবর্তন সম্ভব নয়।
- বাংলাদেশ আইন
- সংসদ চাইলে আইন পরিবর্তন করতে পারে (যেমন খ্রিস্টান/হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন প্রস্তাব এসেছে)।
- মুসলমানদের inheritance আইন এখনো শরীয়াহ অনুসারে চললেও ভবিষ্যতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি হতে পারে।
৬. প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য
- মুসলিম আইন
- আত্মীয়স্বজনের পারস্পরিক সমঝোতায় বণ্টন করা যায়।
- এটি ধর্মীয় দায়িত্ব (ইবাদাহ)।
- বাংলাদেশ আইন
- রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন প্রয়োগ ও প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া সম্পত্তির হস্তান্তর বৈধ নয়।
- আধুনিক জমি ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক হিসাব, শেয়ার, ব্যবসা প্রভৃতির উত্তরাধিকার Bangladesh law-এর কাঠামোর মধ্যেই কার্যকর করতে হয়।
টেবিল আকারে তুলনা
বিষয় | মুসলিম উত্তরাধিকার আইন | বাংলাদেশ পারিবারিক/উত্তরাধিকার আইন |
---|---|---|
উৎস | কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস | সংবিধান, সংসদীয় আইন, আদালতের রায় |
প্রকৃতি | চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনীয় | পরিবর্তনযোগ্য (সংসদ দ্বারা) |
বণ্টন নিয়ম | নির্দিষ্ট অংশ, পুরুষ = নারীর দ্বিগুণ | মুসলমানদের জন্য শরীয়াহ অনুসরণ, তবে প্রশাসনিক কাগজপত্র জরুরি |
উইল (Wasiyyah) | সর্বোচ্চ ১/৩, উত্তরাধিকারীর জন্য নয় | রেজিস্ট্রি করা যায়, তবে আদালত সাধারণত শরীয়াহ মেনে চলে |
প্রক্রিয়া | পরিবার/আত্মীয়দের মধ্যে সরাসরি বণ্টন | ওয়ারিশ সনদ, নামজারি, আদালতের ডিক্রি ইত্যাদি |
কার্যকারিতা | ধর্মীয় ইবাদাহ | রাষ্ট্রীয় বৈধতা (legal enforcement) |
পরিবর্তন | সম্ভব নয় | সংসদ চাইলে পরিবর্তনযোগ্য |
👉 সারকথা:
- মুসলিম উত্তরাধিকার আইন হলো আল্লাহর নির্ধারিত ধর্মীয় বিধান, যা পরিবর্তনযোগ্য নয়।
- বাংলাদেশ আইন হলো রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া, যা সেই শরীয়াহ ভিত্তিক উত্তরাধিকারকে বাস্তবে কার্যকর করতে সহায়তা করে এবং প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে।